মৃত্যুদণ্ডাদেশ চূড়ান্ত হওয়ার আগে সাজাপ্রাপ্ত বন্দীকে কনডেম সেলে রাখা যাবে না বলে হাইকোর্টের দেওয়া রায় ২৫ আগস্ট পর্যন্ত স্থগিত করেছেন আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতির আদালত।
বুধবার (১৫ মে) হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের শুনানি নিয়ে আপিল বিভাগের বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের চেম্বার আদালত এই আদেশ দেন।
আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির।
আর রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন। সঙ্গে ছিলেন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল নাসিম ইসলাম রাজু।
শিশির মনির বলেন, এটা একটা ঐতিহাসিক রায়। রায়ে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড চূড়ান্ত হওয়ার পূর্বে তাকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রাপ্ত আসামি বলা যাবে না এবং তাকে কারাগারের নির্জন ডেথ সেলে বন্দী রাখা যাবে না। মৃত্যুদণ্ডাদেশ চূড়ান্ত বলতে এখানে যত বিচারিক ও প্রশাসনিক প্রক্রিয়া আছে সেগুলো শেষ হওয়াকে বোঝানো হয়েছে। বিচার বিভাগীয় পদক্ষেপে যেমন- হাইকোর্ট বিভাগ, আপিল বিভাগ এবং রিভিউয়ের শুনানিকে বোঝানো হয়েছে। প্রশাসনিক পদক্ষেপ হিসেবে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনার সুযোগকে বোঝানো হয়েছে। রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রার্থনার আবেদন খারিজের পরই একজন মানুষের মৃত্যুদণ্ডাদেশ চূড়ান্ত হয়েছে বলা যাবে এবং শুধু তখনই একজন বন্দীকে নির্জন কক্ষে বন্দী রাখা যাবে।
শিশির মনির আরও বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ এ মামলার শুনানিতে বলেছেন, নতুন জেল কোড তৈরি করতে যাচ্ছে, নতুন প্রিজন অ্যাক্ট হচ্ছে। হাইকোর্ট রায়ে বলেছেন, এই রায়ে যেসব পর্যবেক্ষণ দেওয়া হচ্ছে সেগুলো যেন নতুন আইনে প্রতিফলিত হয়।
রায়ের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে শিশির মনির বলেন, আমাদের দেশে হাইকোর্ট বিভাগে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের জামিনের দরখাস্তের শুনানি হয় না। অন্যান্য আসামিদের জামিন শুনানি হয়। তারা জামিন পেয়ে বেরিয়ে যান। কিন্তু মুত্যদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত একবার হলেই তাদের জামিনের আর শুনানি হয়না। এক্ষেত্রে হাইকোর্ট রায়ে বলেছেন, মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত যাদের আপিল বিচারাধীন থাকে, তাদের জামিন আবেদনও যেন অন্যান্য আসামিদের মতো শুনানি করা হয় এবং জামিনও যেন মঞ্জুর করা হয়।
এ আদেশের পর অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, হাইকোর্ট যে নির্দেশনাগুলো দিয়েছেন, সেগুলো চূড়ান্ত হবে আপিল বিভাগের রায়ের পর। সেজন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। হাইকোর্টের রায়ের কপি পাওয়ার পর আপিল বিভাগে একটি নিয়মিত লিভ টু আপিল ফাইল করতে হবে। সেটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। সেজন্য হাইকোর্টের রায়ের কার্যকারিতা আপাতত স্থগিত রাখা প্রয়োজন। সেজন্য আবেদন করেছিলাম। চেম্বার বিচারপতি শুনানি নিয়ে হাইকোর্টের রায়ের কার্যকারিতা স্থগিত করেছেন।
এর আগে সোমবার (১৩ মে) হাইকোর্ট মৃত্যুদণ্ডাদেশ চূড়ান্ত হওয়ার আগে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে কারাগারের কনডেম সেলে বন্দি রাখা অবৈধ ও বেআইনি ঘোষণা করেন।
জনস্বার্থে করা এক রিটের চূড়ান্ত শুনানি করে এমন রায় দেন বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি মো. বজলুর রহমানের বেঞ্চ।
রায়ে আদালত বলেছেন, কোনো আসামির মৃত্যুদণ্ড আপিল বিভাগ এবং রিভিউয়ের পরও বহাল থাকলে এবং রাষ্ট্রপতির ক্ষমার আবেদনও নাকচ হয়ে গেলে তখনই তার ‘মৃত্যুদণ্ডাদেশ চূড়ান্ত’ হয়েছে বলে ধরতে হবে।
একই সঙ্গে মৃত্যুদণ্ডাদেশ ‘চূড়ান্ত হওয়ার আগেই’ যাদের কনডেম সেল রাখা হয়েছে, তাদের পর্যায়ক্রমে সাধারণ সেলে স্থানান্তর করতে জেল কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আর এ কাজের জন্য দুই বছর সময় বেঁধে দিয়েছেন হাইকোর্ট।
তবে বিশেষ ক্ষেত্রে, কোনো দণ্ডিত আসামি যদি তেমন কোনো সংক্রামক ব্যধিতে আক্রান্ত হন যে তাকে অন্যদের সঙ্গে রাখা ঝুঁকিপূর্ণ, তখন তাকে কনডেম সেলে রাখা যেতে পারে বলে মত দিয়েছেন আদালত।
তবে এক্ষেত্রেও আলাদাভাবে দণ্ডিতের বক্তব্য শোনার শর্ত দেওয়া হয়েছে।
হাইকোর্ট জেল কর্তৃপক্ষকে বলেছেন, মৃত্যু সেলে যারা বন্দী থাকেন, তাদের ব্যাপারে কোন সাংবাদিক বা কোন গবেষক বা অন্য কেউ তথ্য অধিকার আইনে দরখাস্ত দিয়ে জানতে চাইলে, যেন বিস্তারিত তথ্য দেওয়া হয়।
এছাড়াও সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছেন, কতজনের মৃত্যুদণ্ড কমছে, কতজনের বহাল থাকছে- এসব ব্যাপারে কোন ব্যক্তি তথ্য অধিকার আইনে বা সাংবাদিকরা তথ্য চাইলে তা যেন দেওয়া হয়।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের এসব তথ্য পরিসংখ্যানসহ সুপ্রিমকোর্টের ওয়েবসাইটে এবং বার্ষিক প্রতিবেদনে প্রকাশও করতে বলা হয়েছে।
রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে কিনা এমন প্রশ্নে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেছেন, সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
এই রায়ের কার্যকারিতা স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ মঙ্গলবার আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতির আদালতে আবেদন করেন। আবেদনের ওপর বুধবার শুনানি শেষে চেম্বার বিচারপতি হাইকোর্টের আদেশের কার্যকারিতা স্থগিত করেন।