ঢাকা ০৩:১১ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার নিয়ে সুন্দরবনের কুমির বরিশালে

  • বার্তা কক্ষ
  • আপডেট সময় : ০৪:২৪:১৮ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৭ মার্চ ২০২৪
  • ২৭ বার পড়া হয়েছে

কুমিরের আচরণ ও গতিবিধি জানতে সম্প্রতি চারটি কুমিরের গায়ে স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার বসিয়ে সুন্দরবনে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে তিনটি কুমির সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকায় চলে যায়। তবে একটি কুমির বন ছেড়ে মংলা, বাগেরহাট, মোড়েলগঞ্জ হয়ে এখন পিরোজপুরে অবস্থান করছে বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে বিবিসি বাংলা।

গত ১৬ মার্চ স্যাটেলাইট ট্যাগ বসিয়ে কুমিরটি অবমুক্ত করা হয়েছিল সুন্দরবনের হারবাড়িয়া পয়েন্টে। মাত্র ১১ দিনে প্রায় ১০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছে কুমিরটি। গায়ে বসানো স্যাটেলাইটের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, কুমিরটি বুধবার (২৭ মার্চ) সকালে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার তুষখালির একটি নদীতে রয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নির্দিষ্ট সময় পর হয়তো আবারো সুন্দরবনে ফিরে আসতে পারে কুমিরটি। তবে আপাতত সে তার নিজের জন্য নিরাপদ পরিবেশ খুঁজছে।

কুমিরের গায়ে স্যাটেলাইট ট্যাগ বসিয়ে নদীতে অবমুক্ত করার কাজটি যৌথভাবে করছে বন বিভাগ ও ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনসারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন)। জার্মানির জিআইজেড’র “ইন্টিগ্রেটেড ম্যানেজমেন্ট অব সুন্দরবন ম্যানগ্রোভস অ্যান্ড দ্যা মেরিন প্রোটেকটেড এরিয়া সোয়াস অব নো গ্রাউন্ড বাংলাদেশ” প্রকল্পের আওতায় এই গবেষণাটি চলছে।

বিশ্বে পাখি, কচ্ছপ, নেকড়েসহ বিভিন্ন প্রাণীর শরীরে স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার বসিয়ে তাদের আচরণ নিয়ে গবেষণার নজীর রয়েছে। তবে বাংলাদেশের কুমির নিয়ে এভাবে গবেষণা এই প্রথম করা হচ্ছে।

স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার বসিয়ে দুই কুমির সুন্দরবনের নদীতে অবমুক্তস্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার বসিয়ে দুই কুমির সুন্দরবনের নদীতে অবমুক্ত

বন বিভাগ বলছে, সুন্দরবনের কুমিরের চলাচল ও গতিপথ সম্পর্কে জানতে স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার বসিয়ে কুমিরের ওপর গবেষণা পরিচালিত হচ্ছে।

বন সংরক্ষক ও বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ ইমরান আহমেদ বলেন, “আমরা মূলত এই গবেষণার মাধ্যমে তাদের আচরণ ও বসবাসের পরিবেশ বোঝার চেষ্টা করেছি। যে কুমিরটি বনের বাইরে গেছে সে হয়তো তার বসবাসের জন্য সুবিধাজনক জায়গা খুঁজছে।”

আইইউসিএনের প্রোগ্রাম ম্যানেজার সারোয়ার আলম দীপু বলেন, “সুন্দরবনের কুমির কোথায়, কীভাবে বিচরণ করে তা নিয়ে বিস্তারিত কোনো গবেষণা হয়নি। সে কারণেই স্যাটেলাইট ট্যাগ বসিয়ে এই গবেষণাটি করা হচ্ছে।”

গবেষণার শুরু যেভাবে
গত ১৩ থেকে ১৬ মার্চের মধ্যে মোট চারটি লোনা পানির কুমিরের শরীরে স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার বসানো হয়। এই চারটি কুমিরের মধ্যে দুটি পুরুষ এবং দুইটি স্ত্রী কুমির।

এদের মধ্যে পুরুষ কুমির জুলিয়েট সুন্দরবনের করমজলে অবস্থিত দেশের একমাত্র সরকারি কুমির প্রজনন কেন্দ্রের পুকুরে ছিল। আর স্ত্রী কুমির মধুকে সম্প্রতি যশোরের কেশবপুর উপজেলার সাগরদাঁড়ির মাইকেল মধুসূদন দত্তের বাড়ির এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়।

এছাড়া বাকি দুটি কুমির ফাঁদ পেতে ধরা হয় সুন্দরবনের খাল থেকে। এই চারটি কুমিরের শরীরে স্যাটেলাইট ট্যাগ স্থাপন করে ছেড়ে দেওয়া হয় সুন্দরবনের খালে।

এই কাজের জন্য অস্ট্রেলিয়া থেকে নিয়ে আসা হয় কুমির গবেষক ড. সামারাভিরা ও পল বেরিকে।

যেভাবে বসানো হয় স্যাটেলাইট ট্যাগ
গত ১৩ মার্চ সুন্দরবনের করমজলের কুমির প্রজনন কেন্দ্র থেকে বাছাই করা হয় জুলিয়েটকে নামের একটি কুমিরকে। সকালেই সেটির শরীরে ট্যাগ বসানোর কাজ শুরু হয়। ট্যাগ বসানো শেষে ওই কুমিরটিকে ছেড়ে দেওয়া হয় সুন্দরবনের করমজলের খালে।

যশোরের চিড়িয়াখানা থেকে আনা “মধু” নামের আরেকটি কুমির আনা হয়েছিল আগেই। একই দিন সেটিতেও স্যাটেলাইট ট্যাগ বসানো হয়। পরে সেটিকেও ছাড়া হয় একই খালে।

এর পরের দুই দিন রাতের অন্ধকারে সুন্দরবনের খাল থেকে ফাঁদ পেতে ধরা হয় আরও দুটি কুমির। সেই দুটির গায়েও একইভাবে বসানো হয় এই স্যাটেলাইট ট্যাগ।

গবেষণা সংশ্লিষ্টরা জানান, এই স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার কিটটি যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াইল্ড লাইফ কম্পিউটার নামে একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছে। এটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে এটি পানির নিচে গেলেও যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।

কুমিরের গায়ে বসানো এই ট্রান্সমিটার কিটটির মেয়াদ এক বছর। ব্যাটারিচালিত এই যন্ত্রে থাকে একটি ক্ষুদ্র অ্যান্টেনা। যেটি সরাসরি যুক্ত থাকে স্যাটেলাইটের সঙ্গে। ট্যাগ লাগানোর পরই চালু হয়ে যায় এর লোকেশন অপশন। সেটি প্রতি ঘণ্টার আপডেট তথ্য ম্যাপের মাধ্যমে শেয়ার করে।

কুমিরের মাথার ওপরের অংশে আঁশের মতো যে স্কেল থাকে। ওই স্যাটেলাইট ট্যাগটি বসানোর জন্য সেখানে ছোট একটা ছিদ্র করতে হয়। ওই ছিদ্রের মধ্যেই বসানো হয় এই স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটারটি।

বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ ইমরান আহমেদ বলেন, “এই ট্রান্সমিটার চিপটি খুব হালকা। যার ওজন দুই গ্রামেরও কম। এই ধরনের চিপ বসানো হলে তাতে কুমিরের কোনো ক্ষতি হয় না।”

ট্যাগ বসানো কুমিরগুলো এখন কোথায়?
কুমির প্রজনন কেন্দ্রের জুলিয়েট, যশোরের চিড়িয়াখানা থেকে আনা মধু এবং সুন্দরবনের খাল থেকে ফাঁদ পেতে ধরা আরও দুটি কুমিরের গতিপথ পর্যালোচনা করা হচ্ছে ওই দিন থেকেই। এতে দেখা গেছে, তিনটি কুমির আছে সুন্দরবনের মধ্যে। কিন্তু একটি কুমির অন্য পথে চলতে শুরু করেছে।

১৬ মার্চ যে কুমিরটিকে সুন্দরবনের জংলা খাল থেকে ধরে গায়ে স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার বসানো হয়, এর পরদিন থেকেই ওই কুমিরটি সুন্দরবন ছেড়ে ছুটছে লোকালয়ের দিকে।

গত দশদিনে কুমিরটির গতিপথ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এই কুমিরটি সুন্দরবনের হারবাড়িয়া পয়েন্ট থেকে মংলা, রামপাল, বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ হয়ে বরিশাল বিভাগের পিরোজপুর জেলায় পৌঁছেছে।

কুমির নিয়ে এ ধরনের গবেষণা কেন?
বর্তমানে বাংলাদেশে কেবল সুন্দরবন এলাকাতেই প্রাকৃতিক পরিবেশে লোনা পানির কুমির দেখা যায়। তারপরও এই পরিবেশে লোনা পানির কুমিরের এই প্রজাতির প্রজনন খুব একটা হচ্ছে না।

আইইউসিএনের গবেষক দলটি বলছে, কুমির নিয়ে এর আগে কিছু গবেষণা হলেও বিশদ কোনো কাজ হয়নি। এ কারণেই কুমিরের অভ্যাস-আচরণ জানার জন্য এই গবেষণাটি করা হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞ ও বন কর্মকর্তারা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন কিংবা লবনাক্ততা বাড়া-কমার কারণেও জীবন-জীবিকায় এক ধরণের প্রভাব পড়ছে। হুমকির মুখে পড়ছে এই বন্যপ্রাণীটি। কুমিরগুলোকে বাঁচাতে তাই এই ধরণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

কেন হুমকির মুখে কুমির?
বাংলাদেশে লোনা পানির কুমির সুন্দরবনের বাইরে দেখা যায় না। আইইউসিএন ২০১৫ সালে বাংলাদেশে বিপন্ন প্রাণীর একটি তালিকা তৈরি করে। যা আইউসিএন রেড লিস্ট নামে পরিচিত। ওই তালিকায় লোনা পানির কুমিরকে বাংলাদেশে বিপন্ন প্রজাতি হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।

এই মুহূর্তে বাংলাদেশে কেবল সুন্দরবনের প্রাকৃতিক পরিবেশেই লোনা পানির কুমির দেখা যায়। এর বাইরে অন্য যেসব কুমির রয়েছে তার অধিকাংশই চিড়িয়াখানাগুলোতে রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লোনা পানির কুমিরের এই প্রজাতির প্রজনন তেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে না।

তাই কুমিরের প্রজনন বৃদ্ধি ও লালন-পালনের জন্য ২০০০ সালে সুন্দরবনের করমজলে বন বিভাগের উদ্যোগে কুমির প্রজনন কেন্দ্র স্থাপন করা হয়।

কুমির প্রজনন কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক আজাদ কবীর বলেন, “এ পর্যন্ত কয়েক দফায় এই প্রজনন কেন্দ্রে জন্ম নেওয়া লোনা পানির দুই শতাধিক কুমির ছাড়া হয় সুন্দরবনের খালগুলোতে। এর মধ্যে লোনা পানির কুমির আছে ১০৭টি আর মিষ্টি পানির কুমির আছে মাত্র তিনটি।

গবেষক ও বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন, পানিতে লবণাক্ততা হ্রাস-বৃদ্ধি, নদীতে জাল দিয়ে মাছ ধরা, নৌযান চলাচল বৃদ্ধিসহ বেশ কিছু কারণে বর্তমানে সুন্দরবন থেকে কুমিরের সংখ্যা দিন দিন কমছে।

ট্যাগস :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

আপলোডকারীর তথ্য

ডিবি কার্যালয় থেকে বেরিয়ে যা বললেন মাওলানা মামুনুল হক

স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার নিয়ে সুন্দরবনের কুমির বরিশালে

আপডেট সময় : ০৪:২৪:১৮ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৭ মার্চ ২০২৪

কুমিরের আচরণ ও গতিবিধি জানতে সম্প্রতি চারটি কুমিরের গায়ে স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার বসিয়ে সুন্দরবনে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে তিনটি কুমির সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকায় চলে যায়। তবে একটি কুমির বন ছেড়ে মংলা, বাগেরহাট, মোড়েলগঞ্জ হয়ে এখন পিরোজপুরে অবস্থান করছে বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে বিবিসি বাংলা।

গত ১৬ মার্চ স্যাটেলাইট ট্যাগ বসিয়ে কুমিরটি অবমুক্ত করা হয়েছিল সুন্দরবনের হারবাড়িয়া পয়েন্টে। মাত্র ১১ দিনে প্রায় ১০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছে কুমিরটি। গায়ে বসানো স্যাটেলাইটের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, কুমিরটি বুধবার (২৭ মার্চ) সকালে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার তুষখালির একটি নদীতে রয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নির্দিষ্ট সময় পর হয়তো আবারো সুন্দরবনে ফিরে আসতে পারে কুমিরটি। তবে আপাতত সে তার নিজের জন্য নিরাপদ পরিবেশ খুঁজছে।

কুমিরের গায়ে স্যাটেলাইট ট্যাগ বসিয়ে নদীতে অবমুক্ত করার কাজটি যৌথভাবে করছে বন বিভাগ ও ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনসারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন)। জার্মানির জিআইজেড’র “ইন্টিগ্রেটেড ম্যানেজমেন্ট অব সুন্দরবন ম্যানগ্রোভস অ্যান্ড দ্যা মেরিন প্রোটেকটেড এরিয়া সোয়াস অব নো গ্রাউন্ড বাংলাদেশ” প্রকল্পের আওতায় এই গবেষণাটি চলছে।

বিশ্বে পাখি, কচ্ছপ, নেকড়েসহ বিভিন্ন প্রাণীর শরীরে স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার বসিয়ে তাদের আচরণ নিয়ে গবেষণার নজীর রয়েছে। তবে বাংলাদেশের কুমির নিয়ে এভাবে গবেষণা এই প্রথম করা হচ্ছে।

স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার বসিয়ে দুই কুমির সুন্দরবনের নদীতে অবমুক্তস্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার বসিয়ে দুই কুমির সুন্দরবনের নদীতে অবমুক্ত

বন বিভাগ বলছে, সুন্দরবনের কুমিরের চলাচল ও গতিপথ সম্পর্কে জানতে স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার বসিয়ে কুমিরের ওপর গবেষণা পরিচালিত হচ্ছে।

বন সংরক্ষক ও বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ ইমরান আহমেদ বলেন, “আমরা মূলত এই গবেষণার মাধ্যমে তাদের আচরণ ও বসবাসের পরিবেশ বোঝার চেষ্টা করেছি। যে কুমিরটি বনের বাইরে গেছে সে হয়তো তার বসবাসের জন্য সুবিধাজনক জায়গা খুঁজছে।”

আইইউসিএনের প্রোগ্রাম ম্যানেজার সারোয়ার আলম দীপু বলেন, “সুন্দরবনের কুমির কোথায়, কীভাবে বিচরণ করে তা নিয়ে বিস্তারিত কোনো গবেষণা হয়নি। সে কারণেই স্যাটেলাইট ট্যাগ বসিয়ে এই গবেষণাটি করা হচ্ছে।”

গবেষণার শুরু যেভাবে
গত ১৩ থেকে ১৬ মার্চের মধ্যে মোট চারটি লোনা পানির কুমিরের শরীরে স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার বসানো হয়। এই চারটি কুমিরের মধ্যে দুটি পুরুষ এবং দুইটি স্ত্রী কুমির।

এদের মধ্যে পুরুষ কুমির জুলিয়েট সুন্দরবনের করমজলে অবস্থিত দেশের একমাত্র সরকারি কুমির প্রজনন কেন্দ্রের পুকুরে ছিল। আর স্ত্রী কুমির মধুকে সম্প্রতি যশোরের কেশবপুর উপজেলার সাগরদাঁড়ির মাইকেল মধুসূদন দত্তের বাড়ির এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়।

এছাড়া বাকি দুটি কুমির ফাঁদ পেতে ধরা হয় সুন্দরবনের খাল থেকে। এই চারটি কুমিরের শরীরে স্যাটেলাইট ট্যাগ স্থাপন করে ছেড়ে দেওয়া হয় সুন্দরবনের খালে।

এই কাজের জন্য অস্ট্রেলিয়া থেকে নিয়ে আসা হয় কুমির গবেষক ড. সামারাভিরা ও পল বেরিকে।

যেভাবে বসানো হয় স্যাটেলাইট ট্যাগ
গত ১৩ মার্চ সুন্দরবনের করমজলের কুমির প্রজনন কেন্দ্র থেকে বাছাই করা হয় জুলিয়েটকে নামের একটি কুমিরকে। সকালেই সেটির শরীরে ট্যাগ বসানোর কাজ শুরু হয়। ট্যাগ বসানো শেষে ওই কুমিরটিকে ছেড়ে দেওয়া হয় সুন্দরবনের করমজলের খালে।

যশোরের চিড়িয়াখানা থেকে আনা “মধু” নামের আরেকটি কুমির আনা হয়েছিল আগেই। একই দিন সেটিতেও স্যাটেলাইট ট্যাগ বসানো হয়। পরে সেটিকেও ছাড়া হয় একই খালে।

এর পরের দুই দিন রাতের অন্ধকারে সুন্দরবনের খাল থেকে ফাঁদ পেতে ধরা হয় আরও দুটি কুমির। সেই দুটির গায়েও একইভাবে বসানো হয় এই স্যাটেলাইট ট্যাগ।

গবেষণা সংশ্লিষ্টরা জানান, এই স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার কিটটি যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াইল্ড লাইফ কম্পিউটার নামে একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছে। এটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে এটি পানির নিচে গেলেও যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।

কুমিরের গায়ে বসানো এই ট্রান্সমিটার কিটটির মেয়াদ এক বছর। ব্যাটারিচালিত এই যন্ত্রে থাকে একটি ক্ষুদ্র অ্যান্টেনা। যেটি সরাসরি যুক্ত থাকে স্যাটেলাইটের সঙ্গে। ট্যাগ লাগানোর পরই চালু হয়ে যায় এর লোকেশন অপশন। সেটি প্রতি ঘণ্টার আপডেট তথ্য ম্যাপের মাধ্যমে শেয়ার করে।

কুমিরের মাথার ওপরের অংশে আঁশের মতো যে স্কেল থাকে। ওই স্যাটেলাইট ট্যাগটি বসানোর জন্য সেখানে ছোট একটা ছিদ্র করতে হয়। ওই ছিদ্রের মধ্যেই বসানো হয় এই স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটারটি।

বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ ইমরান আহমেদ বলেন, “এই ট্রান্সমিটার চিপটি খুব হালকা। যার ওজন দুই গ্রামেরও কম। এই ধরনের চিপ বসানো হলে তাতে কুমিরের কোনো ক্ষতি হয় না।”

ট্যাগ বসানো কুমিরগুলো এখন কোথায়?
কুমির প্রজনন কেন্দ্রের জুলিয়েট, যশোরের চিড়িয়াখানা থেকে আনা মধু এবং সুন্দরবনের খাল থেকে ফাঁদ পেতে ধরা আরও দুটি কুমিরের গতিপথ পর্যালোচনা করা হচ্ছে ওই দিন থেকেই। এতে দেখা গেছে, তিনটি কুমির আছে সুন্দরবনের মধ্যে। কিন্তু একটি কুমির অন্য পথে চলতে শুরু করেছে।

১৬ মার্চ যে কুমিরটিকে সুন্দরবনের জংলা খাল থেকে ধরে গায়ে স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার বসানো হয়, এর পরদিন থেকেই ওই কুমিরটি সুন্দরবন ছেড়ে ছুটছে লোকালয়ের দিকে।

গত দশদিনে কুমিরটির গতিপথ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এই কুমিরটি সুন্দরবনের হারবাড়িয়া পয়েন্ট থেকে মংলা, রামপাল, বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ হয়ে বরিশাল বিভাগের পিরোজপুর জেলায় পৌঁছেছে।

কুমির নিয়ে এ ধরনের গবেষণা কেন?
বর্তমানে বাংলাদেশে কেবল সুন্দরবন এলাকাতেই প্রাকৃতিক পরিবেশে লোনা পানির কুমির দেখা যায়। তারপরও এই পরিবেশে লোনা পানির কুমিরের এই প্রজাতির প্রজনন খুব একটা হচ্ছে না।

আইইউসিএনের গবেষক দলটি বলছে, কুমির নিয়ে এর আগে কিছু গবেষণা হলেও বিশদ কোনো কাজ হয়নি। এ কারণেই কুমিরের অভ্যাস-আচরণ জানার জন্য এই গবেষণাটি করা হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞ ও বন কর্মকর্তারা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন কিংবা লবনাক্ততা বাড়া-কমার কারণেও জীবন-জীবিকায় এক ধরণের প্রভাব পড়ছে। হুমকির মুখে পড়ছে এই বন্যপ্রাণীটি। কুমিরগুলোকে বাঁচাতে তাই এই ধরণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

কেন হুমকির মুখে কুমির?
বাংলাদেশে লোনা পানির কুমির সুন্দরবনের বাইরে দেখা যায় না। আইইউসিএন ২০১৫ সালে বাংলাদেশে বিপন্ন প্রাণীর একটি তালিকা তৈরি করে। যা আইউসিএন রেড লিস্ট নামে পরিচিত। ওই তালিকায় লোনা পানির কুমিরকে বাংলাদেশে বিপন্ন প্রজাতি হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।

এই মুহূর্তে বাংলাদেশে কেবল সুন্দরবনের প্রাকৃতিক পরিবেশেই লোনা পানির কুমির দেখা যায়। এর বাইরে অন্য যেসব কুমির রয়েছে তার অধিকাংশই চিড়িয়াখানাগুলোতে রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লোনা পানির কুমিরের এই প্রজাতির প্রজনন তেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে না।

তাই কুমিরের প্রজনন বৃদ্ধি ও লালন-পালনের জন্য ২০০০ সালে সুন্দরবনের করমজলে বন বিভাগের উদ্যোগে কুমির প্রজনন কেন্দ্র স্থাপন করা হয়।

কুমির প্রজনন কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক আজাদ কবীর বলেন, “এ পর্যন্ত কয়েক দফায় এই প্রজনন কেন্দ্রে জন্ম নেওয়া লোনা পানির দুই শতাধিক কুমির ছাড়া হয় সুন্দরবনের খালগুলোতে। এর মধ্যে লোনা পানির কুমির আছে ১০৭টি আর মিষ্টি পানির কুমির আছে মাত্র তিনটি।

গবেষক ও বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন, পানিতে লবণাক্ততা হ্রাস-বৃদ্ধি, নদীতে জাল দিয়ে মাছ ধরা, নৌযান চলাচল বৃদ্ধিসহ বেশ কিছু কারণে বর্তমানে সুন্দরবন থেকে কুমিরের সংখ্যা দিন দিন কমছে।