গাজার দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর রাফাহতে সামরিক অভিযান বন্ধ করতে ইসরাইলকে নির্দেশ দিয়েছে জাতিসংঘের শীর্ষ আদালত আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে)। আদালতের এই রায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সম্পর্কের মধ্যকার দূরত্ব আরও বাড়িয়ে দিল।
ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে নরওয়ে, আয়ারল্যান্ড ও স্পেনের স্বীকৃতি দেওয়ার কথা ঘোষণার একদিন পরই শুক্রবার হেগভিত্তিক আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের এই রায় ইসরায়েলকে আরও চাপের মুখে ফেলেছে।
অন্যদিকে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর পাশাপাশি হামাস নেতাদের বিরুদ্ধেও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা চেয়েছেন পৃথক একটি আন্তর্জাতিক আদালতের চিফ প্রসিকিউটর।
ইসরায়েলের ক্ষেত্রে বিশ্ব সম্প্রদায় থেকে বাইডেন প্রশাসনের অবস্থান ভিন্ন। রাফায় বড় ধরনের আক্রমণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেও অন্যদিকে বাইডেন প্রশাসন জোর দিয়ে বলছে তাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসরায়েল এখন পর্যন্ত এমন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি, যা ‘রেড লাইন’ অতিক্রম করেছে।
আরও পড়ুন: ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার তিন দেশের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়
গত অক্টোবরে ইসরায়েলে হামাসের হামলার পর থেকে দেশটির ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে পূর্ণ শক্তি নিয়ে সামরিক ও রাজনৈতিক সমর্থন দিয়ে আসছে বাইডেন প্রশাসন। এখন আবার জনবসতিপূর্ণ রাফায় পূর্ণ মাত্রার সামরিক অভিযান না চালাতে ইসরায়েলকে চাপ দিচ্ছে তারা।
এ সপ্তাহে হোয়াইট হাউসে এক ব্রিফিংয়ে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেক সুলিভান সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা এখন পর্যন্ত যা দেখেছি তা হলো, ওই এলাকায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযান ছিল সীমিত ও লক্ষ্যবস্তু নির্ধারিত ছিল। ঘনবসতিপূর্ণ শহরাঞ্চলের কেন্দ্রস্থলে কোনো বড় সামরিক অভিযান ছিল না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের এখন দেখতে হবে এখান থেকে কী ঘটে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘গাজায় অভিযান এখনো রাফাহর কেন্দ্রস্থলের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় পৌঁছায়নি।’
চলতি মাসের শুরুর দিকে হোয়াইট হাউস ঘোষণা করে, তারা প্রায় সাড়ে তিন হাজার বোমার চালান স্থগিত করছে, যার মধ্যে দুই হাজার পাউন্ড ওজনের বিস্ফোরক রয়েছে। এই ধরনের বিস্ফোরকের কারণেই বেসামরিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে বলে উল্লেখ করেছে বাইডেন প্রশাসন।
সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেন, ‘যদি তারা রাফাহতে যায়, তাহলে আমি সেই অস্ত্র সরবরাহ করব না।’
ইসরায়েলের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে গিয়ে মার্কিন কর্মকর্তারা বলেছেন, রাফাহতে হামাসের হাতে অপহৃত ইসরায়েলি জিম্মিদের ফিরিয়ে দেওয়ার চুক্তির আলোচনাকে দুর্বল করে দেবে এবং বাইডেন প্রশাসনের পক্ষ থেকে অস্ত্র পাঠানোর বিষয়টির ওপরও প্রভাব ফেলবে।
তবে এই সপ্তাহে সুলিভান ইসরায়েল ও সৌদি আরব সফর থেকে ফিরে আসার পরে হোয়াইট হাউসের পক্ষ থেকে বক্তব্যে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। তিনি বলেন, রাফাহ থেকে হামাসকে সমূলে উৎখাতে ইসরায়েলের পরিকল্পনায় পরিবর্তন এসেছে সেটি তাকে জানানো হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রশাসনের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, সফরকালে নেতানিয়াহু ও অন্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে সুলিভানের সাক্ষাৎকালে রাফাহ নিয়ে বাইডেনের অনেক উদ্বেগের সমাধান দিয়েছে ইসরায়েলি পক্ষ।
ওই কর্মকর্তা বলেন, বাইডেন প্রশাসন ইসরায়েলি পরিকল্পনাকে সবুজ সংকেত দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে কিন্তু ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনার উদ্যোগ থেকে বোঝা যাচ্ছে তারা বাইডেনের উদ্বেগকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে।
বাইডেনের উদ্বেগের কথা মাথায় রেখে ইসরায়েল কর্তৃপক্ষের পরিকল্পনায় এই পরিবর্তন রাফাহতে আটকে থাকা ফিলিস্তিনিদের জন্য সান্ত্বনাস্বরূপ। গত কয়েক মাসে অন্যান্য এলাকা থেকে পালিয়ে ১০ লাখেরও বেশি মানুষ সেখানে আশ্রয় নিয়েছিল কিন্তু প্রায় ৯ লাখ মানুষ শহরটি ছেড়ে পালিয়ে গেছে।
ইসরায়েল অন্য প্রধান সীমান্ত ক্রসিং কেরেম শালোম দিয়ে শত শত সাহায্যবহনকারী ট্রাক নিয়ে এসেছে, তবে জাতিসংঘ এবং ত্রাণ সংস্থাগুলো বলছে, ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর অভিযানের কারণে ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিদের জন্য খাবার, পানি ও অন্যান্য সরবরাহ গ্রহণ করা তাদের পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে।
ইউএস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট বলছে, দিনে প্রতিদিন অন্তত ৬০০ ট্রাক খাদ্য ও অন্যান্য সহায়তা প্রয়োজন। তাহলে উত্তরে ইউএসএআইডি ও জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির প্রধানের ব্যাখায় যে দুর্ভিক্ষের সূত্রপাত হতে যাচ্ছে তা রোধ করা যাবে এবং দক্ষিণে এটি ছড়িয়ে পড়া ঠেকানো যাবে।
এমনকি সমুদ্রপথে একটি মার্কিন জেটি অল্প পরিমাণে সহায়তা আনতে শুরু করলেও ইসরায়েলি আক্রমণ শুরুর পর থেকে যে পরিমাণ সরবরাহের প্রয়োজন তার তুলনায় স্বল্প পরিমাণই পেয়েছে গাজাবাসীরা।
গাজায় যুদ্ধ বন্ধে ইসরায়েলকে দেওয়া আইসিজের এই রায়কে স্বাগত জানিয়েছে নেতৃস্থানীয় আন্তর্জাতিক মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো। তারা আশা করেছিল যে এই রায় ইসরায়েলের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে। ডক্টরস উইদাউট বর্ডার্স বলেছে, এই রায়ে নিশ্চিত হয়েছে যে গাজায় ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকরা কতটা ‘বিপর্যয়কর’ পরিস্থিতিতে আছে এবং ‘অবিলম্বে আরও মানবিক সহায়তার ব্যাপক মাত্রায় প্রয়োজন’ রয়েছে।
তবে গাজায় আক্রমণ বন্ধ, এই অঞ্চলে মানবিক সহায়তা বাড়ানো এবং যুদ্ধাপরাধ তদন্তকারীদের জন্য গাজায় প্রবেশ নিয়ে আদালতের আদেশ মেনে চলতে ইসরায়েলকে বাধ্য করার কোনো সুযোগ নেই।
শুক্রবারের আইসিজের এই রায়ের পর ইসরায়েলের গতিপথের কোনো পরিবর্তনের লক্ষণ দেখা যায়নি। গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলায় ১ হাজার ২০০ জনের মৃত্যু হয়, যাদের প্রায় এক-চতুর্থাংশ সৈন্য এবং আরও ২৫০ জনকে বন্দি করা হয়। তারপর থেকে ইসরায়েলের হামলায় গাজায় অন্তত ৩৫ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে যাদের অধিকাংশই বেসামরিক।
আদালতের দাবিগুলো যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের কাছে যা চেয়েছে তার চেয়েও বেশি যদিও ওয়াশিংটন ইঙ্গিত দিয়েছে যে তারা গাজায় আরও অভিযান চালানো বিপক্ষে।
বুধবার মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন দ্য হাউজ ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটিকে বলেন, ‘রাফাহর ওপর পূর্ণ সামরিক হামলা বেসামরিক জনগণের যে ক্ষতি করতে পারে তা নিয়ে আমরা দীর্ঘদিন ধরে আমাদের উদ্বেগের কথা জানিয়ে আসছি। রাফাহকে রক্ষার সুস্পষ্ট এবং বিশ্বাসযোগ্য কোনো পরিকল্পনাও নেই।’
ব্লিংকেন আরও বলেন, প্রশাসন বিশ্বাস করে না যে ইসরায়েল যে ফলাফল অর্জন করতে চাইছে রাফাহতে একটি বড় আক্রমণের মাধ্যমে তা অর্জন করতে পারবে। এটি হামাসের সঙ্গে কার্যকরভাবে এবং টেকসইভাবে মোকাবিলার মাধ্যমে করতে হবে।
রাফায় পূর্ণাঙ্গ সামরিক হামলার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন ব্লিংকেন। তিনি মনে করেন, হামাসের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আরও অনেক উপায় রয়েছে যেগুলো আরও কার্যকর এবং আরও টেকসই হতে পারে।