ঢাকা ০৬:১৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ২০ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

যদি মারা যাই, লোকে তোমাদের ‘শহীদের স্ত্রী-সন্তান’ বলে ডাকবে

  • বার্তা কক্ষ
  • আপডেট সময় : ০৫:৫৭:৩৫ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪
  • ২০ বার পড়া হয়েছে

 

‘‘আমি আন্দোলনে গেলে শহীদ হব। যদি মারা যাই, লোকে তোমাদের ‘শহীদের স্ত্রী-সন্তান’ বলে ডাকবে। আর আমার সন্তান মারা গেলে, তখন সবাই আমাদেরকে শহীদের বাবা-মা বলে ডাকবে।’’

আন্দোলনে যেতে নিষেধ করলে মাজহারুল ইসলাম মাসরুর ওরফে আলী আজগর (২৯) তার সহধর্মিণী বিবি সালমাকে এসব কথা বলতেন।

মঙ্গলবার (২৪ সেপ্টেম্বর) দুপুরে নবাগত শিশুকে কোলে নিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বিবি সালমা ঢাকা পোস্টকে এ কথা জানান।

লক্ষ্মীপুরের কমলনগরের বাসিন্দা মাজহারুল ইসলাম মাসরুর ৫ আগস্ট গাজীপুরে পুলিশের গুলিতে নিহত হন।

মাসরুর যখন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান তখন তার স্ত্রী সালমা আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। তার মৃত্যুর দেড় মাস পর গত রোববার (২২ সেপ্টেম্বর) স্ত্রীর কোলজুড়ে আসে ফুটফুটে একটি ছেলে সন্তান। শিশুটির এখনো নাম রাখা হয়নি।

সাড়ে তিন বছর বয়সী নাফিজা আক্তার নামে এক কন্যা সন্তানও রয়েছে তাদের। প্রতিদিন বাবার সঙ্গে মোবাইলফোনে কথা বলত নাফিজা। গত দেড় মাস বাবার সঙ্গে তার কথা হয় না। বাবার কথা জিজ্ঞেস করতেই দুচোখ পানিতে ভিজে যায় ছোট্ট নাফিজার।

শহীদ মাসরুরের স্ত্রী বিবি সালমা বলেন, তিনি আমাকে বলেছিলেন আন্দোলনে তার সঙ্গী হতে। আমাকে আন্দোলনে যেতে বুঝিয়ে গেছেন। হাজিরহাটে মিছিল হবে, আমাকে যেতে বলেছেন। সঙ্গে আমার সন্তানকে নেওয়ার জন্যও বলেছিলেন। এখন সবাই আছে, শুধু মাসরুর নেই। এখন আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার, কোথায় যাব, কী করব আল্লাহপাক জানেন।

৫ আগস্টও সালমার সঙ্গে মাসরুরের কথা হয়। তখন মাসরুর দোকানে ছিলেন। সালমাকে তিনি জানিয়েছিলেন, তিনি আন্দোলনে যাবেন। সালমা খাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগে আন্দোলন তারপর খাওয়া-দাওয়া। পরে সালমা তার ভাইয়ের কাছে জানতে পারেন মাসরুর মারা গেছেন।

৫ আগস্ট গাজীপুরে আন্দোলনে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান মাসরুর। লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার পাটওয়ারীর হাট ইউনিয়নের চরবড়ালিয়া গ্রামের বৃদ্ধ আবদুল খালেকের ছেলে তিনি। জীবিকার তাগিদে তিনি মাদরাসায় শিক্ষকতা, পোলট্রি খামার ও ইলেকট্রিক সরঞ্জামের ব্যবসা করেছেন। তবে কোথাও স্থায়ী হতে পারেননি। সবশেষ প্রায় সাত মাস আগে গাজীপুরে তার শ্বশুর মো. মোস্তফার কাছে যান ব্যবসা করার উদ্দেশ্যে। সেখানে ব্যবসায় ভালোই করছিলেন। কিন্তু ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের রাজনীতি করায় সরকার পতনের আন্দোলনে সবসময় সক্রিয় ছিলেন তিনি। মাসরুর ইসলামী আন্দোলনের পাটওয়ারীর হাট ইউনিয়ন শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন।

মাসরুরের শিক্ষকতা জীবনের সহকর্মী সিরাজুল ইসলাম মেহরাজ বলেন, ঘটনার দিন মাসরুর তার এক বন্ধুকে বলেছিল, গুলিবিদ্ধ কেউ একজনকে তিনি হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছেন। গুলিবিদ্ধ সেই লোকটি তার বন্ধু ছিল। এরপর আর তার সঙ্গে কোনো কথা হয়নি। পরে গাজীপুরের শহীদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে তার মরদেহ পাওয়া যায়। ধারণা করা হচ্ছে—গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাকেই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পরিবার বা আত্মীয়-স্বজনদের দুশ্চিন্তায় না ফেলতে সেদিন তিনি ঘটনাটি লুকিয়েছিলেন।

মাসরুরের ছোট ভাই হুমায়ুন কবির বলেন, আমার ভাই জীবনে অনেক কষ্ট করেছেন। নিজে পড়ালেখা করেছেন। পাশাপাশি আমাদের জন্য কষ্ট করেছেন। তিনি একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন। পরে ওই মাদরাসার দায়িত্ব আমাকে বুঝিয়ে দিয়ে তিনি গাজীপুরে ব্যবসা করতে যান। আমার ভাই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। সবাই বলেছে, তার শরীরের একটা গুলি লেগেছে। তবে শেষ গোসলের সময় তার পেটে ও পিঠে দুটি গুলির চিহ্ন দেখা গেছে।

মাসরুরের চাচা শ্বশুর ওমর ফারুক বলেন, মাসরুর আর্থিকভাবে তেমন একটা স্বাবলম্বী ছিলেন না। গাজীপুর যাওয়ার আগে তার অন্ত্বঃসত্ত্বা স্ত্রীকে শ্বশুর বাড়িতে রেখে যান। এখন তো কোনোভাবে দিন কাটছে তাদের। সামনে তারা কীভাবে চলবে? যতই সময় যাচ্ছে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়ছে। সরকার যদি পরিবারটির দিকে মুখ তুলে তাকায় হয়তো মাসরুরের স্ত্রী ছেলে-মেয়েকে নিয়ে স্বাভাবিকভাবে জীবনযাপন করতে পারবে মেয়েটা।

মাসরুরের কথা জিজ্ঞেস করতেই তার বৃদ্ধ বাবা আবদুল খালেকের চোখ থেকে পানি ঝরতে শুরু করে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, মাসরুর সবার চেয়ে ভালো ছিল। পরিবারের সবার দেখভাল করত। দ্বীনের কাজে গিয়ে সে মারা গেছে। আমি শুকরিয়া আদায় করছি। মৃত্যু তো ঠেকানো যায় না, বাড়িতে থাকলেও মারা যেত। তার ছেলে-মেয়ে ও স্ত্রীর বিষয়ে পারিবারিকভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

প্রসঙ্গত, মাসরুরের মৃত্যুতে লক্ষ্মীপুর জেলা শহরের দক্ষিণ তেমুহনী এলাকাকে ‘শহীদ মাসরুর’ চত্বর ঘোষণা করা হয়েছে। সড়কের পূর্বপাশে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মাসরুর চত্বর নামে একটি বড় ব্যানার সাঁটানো হয়েছে।

 

ট্যাগস :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

আপলোডকারীর তথ্য

সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরী আর নেই

যদি মারা যাই, লোকে তোমাদের ‘শহীদের স্ত্রী-সন্তান’ বলে ডাকবে

আপডেট সময় : ০৫:৫৭:৩৫ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪

 

‘‘আমি আন্দোলনে গেলে শহীদ হব। যদি মারা যাই, লোকে তোমাদের ‘শহীদের স্ত্রী-সন্তান’ বলে ডাকবে। আর আমার সন্তান মারা গেলে, তখন সবাই আমাদেরকে শহীদের বাবা-মা বলে ডাকবে।’’

আন্দোলনে যেতে নিষেধ করলে মাজহারুল ইসলাম মাসরুর ওরফে আলী আজগর (২৯) তার সহধর্মিণী বিবি সালমাকে এসব কথা বলতেন।

মঙ্গলবার (২৪ সেপ্টেম্বর) দুপুরে নবাগত শিশুকে কোলে নিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বিবি সালমা ঢাকা পোস্টকে এ কথা জানান।

লক্ষ্মীপুরের কমলনগরের বাসিন্দা মাজহারুল ইসলাম মাসরুর ৫ আগস্ট গাজীপুরে পুলিশের গুলিতে নিহত হন।

মাসরুর যখন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান তখন তার স্ত্রী সালমা আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। তার মৃত্যুর দেড় মাস পর গত রোববার (২২ সেপ্টেম্বর) স্ত্রীর কোলজুড়ে আসে ফুটফুটে একটি ছেলে সন্তান। শিশুটির এখনো নাম রাখা হয়নি।

সাড়ে তিন বছর বয়সী নাফিজা আক্তার নামে এক কন্যা সন্তানও রয়েছে তাদের। প্রতিদিন বাবার সঙ্গে মোবাইলফোনে কথা বলত নাফিজা। গত দেড় মাস বাবার সঙ্গে তার কথা হয় না। বাবার কথা জিজ্ঞেস করতেই দুচোখ পানিতে ভিজে যায় ছোট্ট নাফিজার।

শহীদ মাসরুরের স্ত্রী বিবি সালমা বলেন, তিনি আমাকে বলেছিলেন আন্দোলনে তার সঙ্গী হতে। আমাকে আন্দোলনে যেতে বুঝিয়ে গেছেন। হাজিরহাটে মিছিল হবে, আমাকে যেতে বলেছেন। সঙ্গে আমার সন্তানকে নেওয়ার জন্যও বলেছিলেন। এখন সবাই আছে, শুধু মাসরুর নেই। এখন আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার, কোথায় যাব, কী করব আল্লাহপাক জানেন।

৫ আগস্টও সালমার সঙ্গে মাসরুরের কথা হয়। তখন মাসরুর দোকানে ছিলেন। সালমাকে তিনি জানিয়েছিলেন, তিনি আন্দোলনে যাবেন। সালমা খাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগে আন্দোলন তারপর খাওয়া-দাওয়া। পরে সালমা তার ভাইয়ের কাছে জানতে পারেন মাসরুর মারা গেছেন।

৫ আগস্ট গাজীপুরে আন্দোলনে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান মাসরুর। লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার পাটওয়ারীর হাট ইউনিয়নের চরবড়ালিয়া গ্রামের বৃদ্ধ আবদুল খালেকের ছেলে তিনি। জীবিকার তাগিদে তিনি মাদরাসায় শিক্ষকতা, পোলট্রি খামার ও ইলেকট্রিক সরঞ্জামের ব্যবসা করেছেন। তবে কোথাও স্থায়ী হতে পারেননি। সবশেষ প্রায় সাত মাস আগে গাজীপুরে তার শ্বশুর মো. মোস্তফার কাছে যান ব্যবসা করার উদ্দেশ্যে। সেখানে ব্যবসায় ভালোই করছিলেন। কিন্তু ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের রাজনীতি করায় সরকার পতনের আন্দোলনে সবসময় সক্রিয় ছিলেন তিনি। মাসরুর ইসলামী আন্দোলনের পাটওয়ারীর হাট ইউনিয়ন শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন।

মাসরুরের শিক্ষকতা জীবনের সহকর্মী সিরাজুল ইসলাম মেহরাজ বলেন, ঘটনার দিন মাসরুর তার এক বন্ধুকে বলেছিল, গুলিবিদ্ধ কেউ একজনকে তিনি হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছেন। গুলিবিদ্ধ সেই লোকটি তার বন্ধু ছিল। এরপর আর তার সঙ্গে কোনো কথা হয়নি। পরে গাজীপুরের শহীদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে তার মরদেহ পাওয়া যায়। ধারণা করা হচ্ছে—গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাকেই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পরিবার বা আত্মীয়-স্বজনদের দুশ্চিন্তায় না ফেলতে সেদিন তিনি ঘটনাটি লুকিয়েছিলেন।

মাসরুরের ছোট ভাই হুমায়ুন কবির বলেন, আমার ভাই জীবনে অনেক কষ্ট করেছেন। নিজে পড়ালেখা করেছেন। পাশাপাশি আমাদের জন্য কষ্ট করেছেন। তিনি একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন। পরে ওই মাদরাসার দায়িত্ব আমাকে বুঝিয়ে দিয়ে তিনি গাজীপুরে ব্যবসা করতে যান। আমার ভাই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। সবাই বলেছে, তার শরীরের একটা গুলি লেগেছে। তবে শেষ গোসলের সময় তার পেটে ও পিঠে দুটি গুলির চিহ্ন দেখা গেছে।

মাসরুরের চাচা শ্বশুর ওমর ফারুক বলেন, মাসরুর আর্থিকভাবে তেমন একটা স্বাবলম্বী ছিলেন না। গাজীপুর যাওয়ার আগে তার অন্ত্বঃসত্ত্বা স্ত্রীকে শ্বশুর বাড়িতে রেখে যান। এখন তো কোনোভাবে দিন কাটছে তাদের। সামনে তারা কীভাবে চলবে? যতই সময় যাচ্ছে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়ছে। সরকার যদি পরিবারটির দিকে মুখ তুলে তাকায় হয়তো মাসরুরের স্ত্রী ছেলে-মেয়েকে নিয়ে স্বাভাবিকভাবে জীবনযাপন করতে পারবে মেয়েটা।

মাসরুরের কথা জিজ্ঞেস করতেই তার বৃদ্ধ বাবা আবদুল খালেকের চোখ থেকে পানি ঝরতে শুরু করে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, মাসরুর সবার চেয়ে ভালো ছিল। পরিবারের সবার দেখভাল করত। দ্বীনের কাজে গিয়ে সে মারা গেছে। আমি শুকরিয়া আদায় করছি। মৃত্যু তো ঠেকানো যায় না, বাড়িতে থাকলেও মারা যেত। তার ছেলে-মেয়ে ও স্ত্রীর বিষয়ে পারিবারিকভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

প্রসঙ্গত, মাসরুরের মৃত্যুতে লক্ষ্মীপুর জেলা শহরের দক্ষিণ তেমুহনী এলাকাকে ‘শহীদ মাসরুর’ চত্বর ঘোষণা করা হয়েছে। সড়কের পূর্বপাশে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মাসরুর চত্বর নামে একটি বড় ব্যানার সাঁটানো হয়েছে।