রামপুরায় নিজ কর্মস্থলের সামনে গুলিতে আহত আন্দোলনকারীদের পানি পান করাতে গিয়ে উপর থেকে ছোঁড়া গুলিতে নিহত হন কুষ্টিয়ার মো. আলমগীর শেখ।
আলমগীরের স্বজনরা জানান, ১৯ জুলাই জুম্মার নামাজ শেষে স্ত্রীকে রান্নার কথা বলে রামপুরা এলাকায় নিজ কর্মস্থল বেসরকারি ওষুধ কোম্পানী হেলথ কেয়ারে গিয়েছিলেন আলমগীর।
সে সময় হেলিকপ্টার থেকে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি ছোঁড়া হচ্ছিল। অফিসের কাছে গুলিবিদ্ধ কয়েকজন আন্দোলনকারী আহত হয়ে সড়কে লুটিয়ে পড়েন। তখন তিনি পানির বোতল নিয়ে আহতদের পানি পান করাতে যান। সে সময় তিনি নিজেও হেলিকপ্টার থেকে ছোঁড়া গুলিতে আহত হন। আলমগীরের শরীরে তিনটি গুলি লাগে। স্থানীয়রা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিন্তু চিকিৎসকের অভাবে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু হয় আলমগীরের। সেদিন গভীর রাতে অ্যাম্বুলেন্সে করে গ্রামের বাড়িতে লাশ পৌঁছে দেয় তার অফিসের লোকজন। তার গুলিবিদ্ধ মরদেহ গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার শিলাইদহ ইউনিয়নের কসবা কবরস্থানে দাফন করা হয়।
মো. আলমগীর শেখ(৩৬) কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার শিলাইদহ ইউনিয়নের কসবা গ্রামের মুদি দোকানি মো. ইজারুল ও বৃদ্ধা আলেয়া খাতুনের বড় সন্তান। দুই ভাইয়ের মধ্যে আলমগীর বড়। তার স্ত্রী রিমা খাতুন (৩০) দুই শিশু সন্তান মেয়ে তুলি খাতুন (১১) ও ছেলে আব্দুল আওলাদ (৭) কে নিয়ে সীমাহীন অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছেন।
জানা যায়, সংসারের হাল ধরতে গাড়ি চালানো শিখে জীবিকার তাগিদে প্রায় ২০ বছর আগে ঢাকায় পাড়ি জমান মো. আলমগীর শেখ। গত ৮ বছর ধরে ঢাকার রামপুরা এলাকার বেসরকারি ওষুধ কোম্পানি হেলথ কেয়ারের গাড়ি চালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এখানে যে বেতন পেতেন, তা দিয়ে তার দুই সন্তানের লেখাপড়া, বাসা ভাড়াসহ সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হতো। সংসারের কিছুটা স্বচ্ছলতার জন্য অফিসের কাজ শেষে রাইড শেয়ারিং অ্যাপস পাঠাওয়ে মোটরসাইকেলে যাত্রী পরিবহন করতেন। এতে কিছুটা স্বচ্ছলতার মুখ দেখতে শুরু করেছিলো আলমগীরের পরিবার। কিন্তু গত ১৯ জুলাই বিকালে কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে উপর থেকে ছোঁড়া গুলিতে নিহত হন তিনি।
সরেজমিনে আলমগীরের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, মৃত্যুর দুই মাস পার হলেও শোকে মুহ্যমান আলমগীরের পরিবার। কেউ আসলেই ছেলের কথা বলে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন আলমগীরের মা। তার মৃত্যুতে অসহায় হয়ে পড়েছে দুটি পরিবার।
আলমগীরের শোকাতুর মা আলেয়া খাতুন বাসসকে বলেন, আমার ছেলে খুবই ধার্মিক ছিলো। ছেলেটা গুলিবিদ্ধ হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকা মানুষকে পানি খাওয়ানোর জন্য গিয়েছিলো। সেই সময় হেলিকপ্টার থেকে পুলিশ গুলি করে। আমার ছেলের গায়ে তিনটি গুলি লাগে। তারপর বিনা চিকিৎসায় আমার ছেলে মারা গেছে। আমার ছেলেটা এখন নাই। ওর বউ, বাচ্চাদের দেখবে কে? আমার বাড়ি ছাড়া অন্য কোন জায়গা জমি নেই। এখন আমি এদের নিয়ে চলবো কি করে?
আলেয়া খাতুন নিজের পরিবার ও আলমগীরের স্ত্রী ও শিশু সন্তানদের নিয়ে খেয়ে পরে বাঁচার জন্য সরকারের সহযোগিতা চেয়েছেন।
আলমগীরের স্ত্রী রিমা খাতুন বলেন, “আমার স্বামীর চাকরির টাকায় ভালোভাবে সংসার চলতো না। সে জন্য অফিস ছুটির পর ও পাঠাওয়ে মোটরসাইকেল চালাতো। এখনতো আমাদের সব শেষ হয়ে গেলো। আমি এখন শ^শুর-শ^াশুড়ি, ছেলে-মেয়ে নিয়ে কি করে চলবো বুঝতে পারছি না। সরকার একটু সাহায্য সহযোগিতা করলে পরিবার নিয়ে চলতে পারতাম।”
আলমগীরের ছোট ভাই আজাদ জানান, ভাইকে তার সহকর্মীরা হাসপাতালে নিয়ে গেলেও ডাক্তার না থাকায় ভাই বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে। ওর শরীর থেকে গুলি বের করা যায়নি। চিকিৎসকের অভাবে শরীরে গুলি থাকা অবস্থায় ভাইকে দাফন করতে হয়েছে।
আলমগীরের বাবা মো. ইজারুল বলেন, আমি বৃদ্ধ হয়ে গেছি। আলমগীর আমার বড় ছেলে। সেই আমাদের দেখভাল করতো। আমার যে দোকান তা দিয়ে সংসার চলতো না। সেজন্য কষ্ট করে চাকরির অবসরে মোটরসাইকেল চালিয়ে প্রতিমাসে কিছু খরচ পাঠাতো। এখন ছেলের বৌ-বাচ্চার পড়ালেখা ও সংসার চালানো নিয়ে খুবই চিন্তায় আছি।
কুমারখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম মিকাইল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বাসসকে জানান, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আহত ও নিহতদের পরিবারের সদস্যদের খোঁজখবর নেওয়াসহ এসব আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা প্রস্তুতের কাজ করা হচ্ছে। সরকারিভাবে কোন নির্দেশনা ও সহযোগিতা এলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।